বিষয়বস্তুতে চলুন

জর্জ স্টিফেনসন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জর্জ স্টিফেনসন
জন্ম(১৭৮১-০৬-০৯)৯ জুন ১৭৮১
ওয়াইলাম , নর্থম্বারল্যান্ড, ইংল্যান্ড
মৃত্যু১২ আগস্ট ১৮৪৮(1848-08-12) (বয়স ৬৭)
ট্যাপটন হাউস, চেস্টারফিল্ড, ডার্বিশায়ার, ইংল্যান্ড
সমাধিহোলি ট্রিনিটি চার্চ, চেস্টারফিল্ড
দাম্পত্য সঙ্গীফ্রান্সেস হেন্ডারসন (১৮০২-১৮০৬)
এলিজাবেথ হিন্দমার্শ (১৮২৯-১৮৪৫)
এলেন গ্রেগরি (১৮৪৮)
সন্তানরবার্ট স্টিফেনসন (পুত্র)
ফ্রান্সেস স্টিফেনসন (কন্যা)

জর্জ স্টিফেনসন (৯ জুন ১৭৮১ – ১২ আগস্ট ১৮৪৮) যুক্তরাজ্যে শিল্প বিপ্লবের সময়ে, ছিলেন একজন ব্রিটিশ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার [১] এছাড়াও, তিনিই বিশ্বে প্রথম আন্তঃনগর রেলওয়ে লাইন তৈরি করেন। সেকারণে তাকে ফাদার অফ রেলওয়ে বলা হয়ে থাকে। [২] যুক্তরাজ্যে ভিক্টোরীয় যুগে স্টিফেনসনকে শিল্পে প্রযুক্তির প্রয়োগ ও উন্নতির পথিকৃত হিসাবে গণ্য করা হয়। তার প্রবর্তিত ট্র্যাক গেজ, যা ৪ ফুট আট ইঞ্চি (বা ১,৪২২ মিলিমিটার) গেজকে কখনও কখনও স্টিফেনসন গেজ বলা হয়ে থাকে।

ঊনিশ শতকে রেল পরিবহনে তথা শিল্প বিপ্লবে তার প্রযুক্তির আবিষ্কার ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার ও তার পুত্র রবার্ট স্টিফেনসন অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি লোকোমোশন নং ১ ছিল ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে স্টকটন এবং ডার্লিংটন রেলপথে সাধারণ যাত্রী পরিবহণে প্রথম বাষ্পীয় লোকোমোটিভ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া লিভারপুল - ম্যানচেস্টার রেলপথ ছিল বিশ্বে প্রথম আন্তঃনগর রেল পরিষেবা।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

জর্জ স্টিফেনসনের জন্ম ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন নিউকাসল আপন টাইনের নিকটস্থ নর্থম্বারল্যান্ডের ওয়াইলামে ওয়েস্ট মূরের কটেজে এক দরিদ্র কয়লাখনির শ্রমিক পরিবারে। পিতামাতা ছিলেন নিরক্ষর দম্পতি রবার্ট ও মাবেল স্টিফেনসন। পিতা ছিলেন উইলিয়াম কয়লাখনির পাম্পিং ইঞ্জিনের ফায়ারম্যান। জর্জ স্টিফেনসন ছিলেন তার মাতাপিতার দ্বিতীয় সন্তান, [৩] তাদের স্বল্প আয়ের কারণে জর্জের স্কুলে পড়াশোনা হয়নি। আট বৎসর বয়সে জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমদিকে ভেড়া চরানো ও খেত-খামারে কাজ করতেন। দশ বৎসর বয়সের বলিষ্ঠ ও সুঠাম চেহারার জর্জ স্টিফেনসন কয়লাখনিতে খনি হতে উত্তোলিত কয়লাভর্তি গাড়ি ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ পান। তার কাজের দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করে। সতের বৎসর বয়সে ইঞ্জিনম্যানের চাকরি পান। এই সময়ে তিনি নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রখর মেধার জর্জ স্টিফেনসন অল্প দিনেই লিখতে, পড়তে ও অঙ্ক করতে শিখে নেন। তবে তিনি আঠারো বৎসর বয়স পর্যন্ত নিরক্ষরই ছিলেন।

ডায়াল কটেজ, কিলিংওয়ার্থের ওয়েস্ট মূর-এ জর্জ স্টিফেনসন প্রবেশদ্বারে সান-ডায়াল লাগান

[৪]

পরবর্তী কর্মজীবন ও অবদান[সম্পাদনা]

১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ১৯ বৎসর বয়সে জর্জ বিবাহ করেন এবং তাদের দুই সন্তান হয়। তাই স্টিফেনসন বাড়তি উপার্জনের জন্য স্কটল্যান্ড যান। সেখানে নানা যন্ত্রপাতি চালানো ও মেরামতির কাজ শিখে নেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে এক দুর্ঘটনায় তার পিতা দৃষ্টিশক্তি হারান। তিনি ফিরে আসেন নিউক্যাসেলে। খনিতে যে যন্ত্র বিকল হওয়ার কারণে দুর্ঘটনায় পিতা অন্ধ হন, স্টিফেনসন তা সচল করেন। ফলে খনিতেই তিনি ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়ে যান কিলিংওয়ার্থ কোলিয়ারিতে।

লোকোমোটিভ-

তখন থেকেই তিনি কয়লা পরিবহনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করতে নিরন্তর কাজ শুরু করেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের তিনি বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতায় কয়লা বহনের ট্রামের সঙ্গে বাষ্প ইঞ্জিন সংযোগে ইপ্সিত সাফল্য লাভ করেন। তার হাতেই তৈরি হল বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেন - ব্লুচার। ওয়াটারলু'র যুদ্ধে প্রুশিয়ান সেনাপতি ব্লুচার নেপোলিয়ানকে পরাজিত করতে সাহায্য করেছিল, তার স্মরণেই নামকরণ করেছিলেন স্টিফেনসন।

১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের কিলিংওয়ার্থ কোলিয়ারি লোকোমোটিভ , যা ব্লুচার নামে পরিচিত, ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে স্যামুয়েল স্মাইলস রচিত লাইভ্স অফ দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স গ্রন্থে [৫]

প্রথমদিকে এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টার চার মাইল। কিন্তু আট চাকার রেল ইঞ্জিন ৩০ টন কয়লা বহনে সক্ষম ছিল। ফলে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার পরবর্তীতে বন্ধ হয়। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তিনি অনেকগুলি স্টীম লোকোমোটিভ তৈরি করেন।

সেফটি ল্যাম্প বা নিরাপদ লাম্প-

এরপর স্টিফেনসন নিজস্ব শৈলীতে বিস্ফোরণের ঝুঁকি এড়িয়ে কয়লাখনি হতে নির্গত নানা রকমের দাহ্য গ্যাস ব্যবহার করে কয়লাখনি শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ল্যাম্প তৈরি করেন। অন্যদিকে এর ঠিক কিছুদিন আগেই অবশ্য ব্রিটেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি একই ধরনের ল্যাম্প প্রস্তুত করেন। ডেভির কৌশল চুরির (যদিও সঠিক নয়) কারণে মামলা রজু হলে স্টিফেনসন অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে ঝামেলা এড়ান।

হামফ্রে ডেভির সেফটি ল্যাম্পের পাশাপাশি স্টিফেনসনের তৈরি সেফটি ল্যাম্প
বিশ্বের প্রথম রেলপথ-

১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ৮ মাইল দীর্ঘ পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণ মেশিন নির্ভর রেলপথ নির্মাণ করেন। রেল লাইন তৈরিতে তিনি ঢালাই লোহার ব্যবহার করেছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রধান টেকনিশিয়ান হিসাবে ২৫ মাইল (৪০ কিমি) দীর্ঘ স্টকটন-ডার্লিংটন রেলপথ নির্মাণের কাজ পান। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর নবনির্মিত রেলপথে স্টিফেনসনলোকোমোশন নামের ইঞ্জিনের সাহায্যে আশি টন কয়লা নিয়ে ২৪ মাইল (৩৯ কিমি) প্রতি ঘন্টা গতিবেগে ১৪ কিমি পথ অতিক্রম করেন। এভাবেই রেলপথটি যাত্রীসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

স্টকটন-ডার্লিংটন রেলপথের প্রথম স্টীম ইঞ্জিন- লোকোমোশন নং ১
লোকোমোশন-

ইতিমধ্যে জর্জ স্টিফেনসন বিশাল অর্থের অধিকারী হন। স্টকটন-ডার্লিংটন রেলপথে লোকোমোটিভ সরবরাহ করার লক্ষ্যে স্টিফেনসন তার পুত্র রবার্ট স্টিফেনসনকে নিয়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন নিজের রেল ইঞ্জিন লোকোমোশন নং 1 তথা বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে নির্মাণ কোম্পানি- রবার্ট স্টিফেনসন অ্যান্ড কোম্পানি। রবার্ট স্টিফেনসন ছিলেন কোম্পানি র ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে নিউক্যাসলের ফোর্থ স্টীটের ওয়ার্কশপে তৈরি হল- 'অ্যাকটিভ' নামের (পরবর্তীতে 'লোকোমোশন' নামে পরিচিত হয়) স্টীম ইঞ্জিন। এরপর তৈরি হল 'হোপ', 'ডিলিজেন্স' এবং 'ব্লাক ডায়মন্ড'।


জর্জ স্টিফেনসন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জানুয়ারি বার্মিংহামে প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউশন অফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (IMechE)।

পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান[সম্পাদনা]

জর্জ স্টিফেনসন ১৮০২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর ১৯ বৎসর বয়সে ফ্রান্সেস হেন্ডারসনকে বিবাহ করেন। পরবর্তী দুই বৎসরের মধ্যে তাদের দুই সন্তান রবার্ট ও ফ্রান্সেস-এর জন্ম হয়। সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য অবসর সময়ে স্টিফেনসন কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন। শিশুকন্যা ফ্রান্সেস জন্মের তিন সপ্তাহ পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রী ফ্রান্সেসও যক্ষ্মায় মারা যান। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের স্টিফেনসন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন এলিজাবেথ হিন্দমার্শকে। এলিজাবেথ ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ করেন এলেন গ্যেগরিকে। কিন্তু বিবাহের সাত মাস পর প্লুরিসি রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট জর্জ স্টিফেনসন ৬৮ বৎসর বয়সে মারা যান। ডার্বিশায়ার চেস্টারফিল্ডে তাকে সমাহিত করা হয়। [৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "George Stephenson | Biography, Locomotives, & Facts | Britannica"। ৫ জুন ২০২৩। 
  2. "Plaque unveiled for 'Father of Railways' George Stephenson"। BBC। ৯ ডিসেম্বর ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৬Engineer and inventor George Stephenson, regarded as the Father of Railways 
  3. Kirby, M. W. (১৯৮৪)। "Stephenson, George (1781–1848)"। Oxford Dictionary of National Biography (2 সংস্করণ)। Oxford University Press। 
  4. Smiles, Samual (১৮৭৯)। Lives of the Engineers: The Locomotive: George and Robert Stephenson (ইংরেজি ভাষায়)। John Murray। পৃষ্ঠা 23। 
  5. Smiles, Samual (১৮৭৯)। Lives of the Engineers: The Locomotive: George and Robert Stephenson (ইংরেজি ভাষায়)। 3। London: John Murray। পৃষ্ঠা 43। 
  6. Davies, Hunter (১৯৭৫)। George Stephenson। Weidenfeld and Nicolson। আইএসবিএন 0-297-76934-0